একজন অনার্য বৃদ্ধা নারীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরে হোলী উৎসব পালন করা অমানবীক বর্বরতা নয় কি ? (হোলী উৎসবের উৎস কি --- তা জানুন। )
হোলী উৎসব উপলক্ষে চারিদিকে সবাই আনন্দে মতোয়ারা।বাড়ির মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে, বুড়ো-বুড়ি সকলে বাঁধনহারা আনন্দে সামিল হয়েছে। আগের রাতে "বুড়ির ঘর" পোড়ানোর মধ্য দিয়ে এই উৎসবের সূচনা।গ্রাম-গঞ্জ থেকে শুরু করে প্রায় সমস্ত মন্দির গুলিতে উৎসব চলছে। নারী-পুরুষের রং মাখামাখি, অশ্লীলতা, মদের ফোঁয়ারা---আকাশ বাতাস কম্পমান।ক্রমে পরিবেশ উতপ্ত হয়ে ওঠে।এ দুদিন ভালো জামাকাপড় পরে রাস্তা ঘাটে বেরনোর কোন উপায় নেই।শিক্ষা-আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আরো পাঁচ-সাত দিন আগে থেকে স্কুল-কলেজের মধ্যেই চলছে ছাত্র-ছাত্রীদের অশ্লীল-অসভ্য রং খেলা।স্কুল-কলেজ থেকে ভূত হয়ে রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে মনে হয় "সভ্যতার জোকারেরা বড় লজ্জাহীন "।টিভি, মিডিয়ায় সারাদিন ধরে চলে এই অশ্লীল-বর্বরতার চিত্র প্রদর্শন ও রকমারি বিজ্ঞাপন।
ভগবৎ পুরান ( গীতা প্রেস, দ্বাদশ সংস্করন, পাতা- ১৪৫ থেকে ১৫৮) ও নারদ সংহিতায় ( গীতা প্রেস, নবম সংস্করন, পাতা-- ২১৮ থেকে ২২৬,২৩২) হোলীকা অসুরের কাহিনী বর্ণিত আছে।এছাড়া বেশ কয়েকটি সংস্কৃত নাটক, যেমন-- প্রহ্লাদ উপখ্যান, দশকুমার চরিত, ভক্তসুমতি, রত্নাবলী ইত্যাদি নাটকে হোলীকা অসুরের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।সর্বপরি সারা দক্ষিন ভারতসহ মধ্যভারত ও উত্তর-পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের লোকগাথা, লোককথা হিসাবে যে কাহিনী বর্ণিত হয়েছে, সেখানে একে আর্য অনার্যের সংঘাত হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে।কাহিনীটি হলো -----
আর্যরা বা দেবতারা অনার্য মহাপরাক্রম শালী রাজা হিরন্যকাশ্যপের রাজত্ব আক্রমন করলে রাজা হিরন্যকাশ্যপ প্রবল যুদ্ধে আর্যদের পরাজিত করে।যুদ্ধে রাজা হিরন্যকাশ্যপের ছোট ভাই হিরন্যক্ষকে ছলনার দ্বারা বরাহরূপ ধারন করে সেনা পতি ইন্দ্র হত্যা করে।এরপর আর্য সেনাপতি ইন্দ্র একদিন গুপ্ত আক্রমন করে রাজা হিরন্যকাশ্যপের গর্ভ বতী স্ত্রী কায়াধুকে অপহরন করে নিয়ে যায়। কায়াধুর প্রতি অনেক অত্যাচারের পর আর্য তথা দেবতাদের আশ্রয়ে জন্ম হয় প্রহ্লাদের।প্রহ্লাদের পিতৃপরিচয় ভুলিয়ে দিতে জন্মের পর থেকেই আর্য বা দেবতারা তাদের পরিবেশ ও সংস্কৃতিতে পালন করতে থাকে প্রহ্লাদকে।তাই জন্মের পর থেকেই প্রহ্লাদকে দেবতাদের যাগযজ্ঞ, তন্ত্রমন্ত্র ইত্যাদি সংস্কারের প্রতি অনুরক্ত করে তোলা হয় এবং বিষ্ণুর প্রতি তার গভীর ভক্তি-শ্রদ্ধা জাগিয়ে তোলা হয়।এরপর একদিন রাজা হিরন্য কাশ্যপ দেবতাদের আক্রমন করে রাজমহিষী কায়াধু ও রাজপুত্র প্রহ্লাদকে উদ্ধার করে হিরন্যপুরীতে নিয়ে আসে।কিন্তু শিশু প্রহ্লাদের দেবভক্তি ও বিষ্ণুর প্রতি ভক্তি দেখে বিচলিত হয়ে পড়েন।দেবতারা এই সুযোগে প্রহ্লাদের সহযোগীতায় মহাশক্তিশালী অনার্যবীর হিরন্যকাশ্যপকে গভীর ছলনায় ইন্দ্র নরসিংহ রূপ ধারন করে হত্যা করে এবং প্রহ্লাদকে নামে মাত্র সিংহাসনে বসিয়ে রাজকার্য পরিচালনা করে দবরাজ ইন্দ্র।ফলে হিরন্যরাজ্যে দেবতারা যাগযজ্ঞ, বেদবিধি, শৌচাচার ইত্যাদি আর্য সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিতে থাকে এবং দেবরাজ ইন্দ্র প্রহ্লাদের কাছ থেকে প্রতিমুহূর্তে খাদ্যশস্য, সুরা, গরু, অস্ত্র, এমনকি অনার্য যুবতী নারী চাপ দিয়ে আদায় করতে থাকে।অনার্য ভূমিতে দেখা যায় আর্য তথা দেবতাদের আস্ফালন।
হোলীকা ছিলেন হিরন্যকাশ্যপের দিদি অর্থাৎ প্রহ্লাদের পিসিমা। তিনি একদিকে যেমন বিদূষী নারী ছিলেন, অপর দিকে ছিলেন বিচক্ষন, বুদ্ধিমতি, রাজত্ব পরিচালনায় সুদক্ষ, যুদ্ধ কৌশলী এবং প্রজা কল্যানকামী নারী।রাজা হিরন্যকাশ্যপের শক্তির মূল আধারও ছিলেন তিনি ও তাঁর বুদ্ধি-জ্ঞান। এই সহৃদয়া ও প্রজাহিতৈষী নারীকে প্রজারা মাতৃজ্ঞানে শ্রদ্ধা করতেন। প্রহ্লাদের রাজ্যের এরূপ কঠিন পরিস্থিতিতে হোলীকা সর্বপ্রথমে প্রহ্লাদকে তার পূর্বের ইতিহাস ও গৌরব গাথা ধীরে ধীরে স্মরণ করাতে থাকলেন ------ কিভাবে দেবতারা তার কাকা হিরন্যক্ষকে অন্যায় ভাবে হত্যা করেছে, কিভাবে তার গর্ভবতী মাকে দেবরাজ ইন্দ্র হরন করে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করেছে, কিভাবে তার মনকে বিষিয়ে দিয়ে ষড়যন্ত্র করে পিতাকে হত্যা করেছে।ধীরে ধীরে প্রহ্লাদের তার জাতির প্রতি মমত্ব বাড়ে এবং দেবতাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে পিসির কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। অবশেষে হোলীকার সহায়তায় ও পরামর্শে রাজ্যকে সবদিক দিয়ে শক্তিশালী করে গড়ে তোলে। তারপর দেবতাদের উপঢৌকন ( খাদ্যশস্য, গরু, অস্ত্র, সুরা, নারী) দেওয়া বন্ধ করে।দেবতারা খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারে প্রহ্লাদের শক্তির মূল উৎস হলো হোলীকা।হোলীকা জীবিত থাকলে প্রহ্লাদকে যুদ্ধে কোন ভাবেই পরাস্ত করা যাবে না।ফলে তারা যেকোন প্রকারে হোলীকাকে খুন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। অবশেষে গভীর ষড়যন্ত্রের দ্বারা বৃদ্ধা হোলীকাকে হরন করে ফাঁকা মাঠের মাঝে একটা পর্ণ কুটিরে বন্দি করে অনাহারে রাখা হয়।দীর্ঘদিন না খেতে পেয়ে কঙ্কালসার হয়ে যায় তাঁর দেহ।অবশেষে প্রহ্লাদ জানতে পেরে সৈনবাহিনী নিয়ে পিসিকে উদ্ধার করতে গেলে দেবতারা আগে থেকে জানতে পেরে পাতার কুটিরে আগুন ধরিয়ে দেয়।দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে পাতার কুটির।আর তারই মাঝে অনাহারে ক্লিষ্ট কঙ্কালসার এক অনার্য-মূলনিবাসী বৃদ্ধা রমনীকে পুড়িয়ে মারা হয়।আর হোলীকার চিতাভস্ম গায়ে মাখিয়ে বিজয় উল্লাসে মেতে ওঠে আর্য তথা দেবতারা।পরবর্তীকালে ছাই মাখানোর পরিবর্তে গায়ে রং বা আবির মাখানোর রীতি চালু হয়।এই হলো "হোলী"র ইতিহাস।
এখন প্রশ্ন হলো, একজন বৃদ্ধা নারীর নির্মম-নৃশংস হত্যার ঘটনা কখনো কি উৎসব হতে পারে ? এটা সমগ্র নারী সমাজের অপমান নয় কি ? এই উৎসবকে রাষ্ট্র কখনো স্বীকৃতি দিতে পারে ? এটা কি "বেটি বাঁচাও" কর্মসূচীর আদর্শ বিজ্ঞাপন ? নাকি "ডিজিটাল ইন্ডিয়ার" বিজ্ঞাপন ? সর্বপরি অনার্য-মূলনিবাসী-দলিত-বহুজন মানুষের প্রতিনিধি হোলীকার মৃত্যুতে যে উৎসব রচনা করেছে আর্য তথা ব্রাহ্মন্যবাদীরা, সেই উৎসব অনার্য-মূলনিবাসী-দলিত-বহুজন সমাজের মানুষেরা কি পালন করতে পারে ? আসলে দলিত বহুজন মানুষের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে ভুলিয়ে দিয়ে তাদের উপর ব্রাহ্মন্যবাদীদের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে এমন ভাবে চাপিয়ে দিয়েছে যে, বহুজন সমাজ তাদের পূর্বের সমস্ত ইতিহাস ভুলে গিয়ে ব্রাহ্মন্যবাদের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে নিজের ধর্ম ও সংস্কৃতি বলে মনে করছেন। আর বর্তমানে রাষ্ট্র পরিচালনার রাশ রয়েছে বর্ণবাদীদের হাতে। তাই তারা তাদের এই অসভ্য অশ্লীল ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসার করে চলেছে রাষ্ট্রীয় খরচে।সাধারন বহুজন মানুষ সেই আফিমের নেশায় ডুবে রয়েছে।
পরবর্তীকালে এই কাহিনীর উপর রাধা-কৃষ্ণের দোল খেলার কাহিনীকে চাপিয়ে আরো আকর্ষনীয় করে তোলা হয়েছে এবং বর্তমান কালে এই হোলী উৎসবের সঙ্গে বসন্ত উৎসবকে মিলিয়ে দিয়ে একে আরো উৎসব মুখর করে তোলা হয়েছে। কিন্তু এই একবিংশ শতকেও কি দলিত বহুজন সমাজের নারীদের প্রতি খুন, ধর্ষন অত্যাচারের চিত্র এতোটুকুও বদলেছে ? এখনো দলিত নারীকে ধর্ষন করে প্রকাশ্য বাজারের মাঝে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।এখনো দলিত নারী ধর্ষিতা হয়ে কুড়ি ঘন্টা রাস্তার পাশে পড়ে থাকে।ব্রাহ্মন্যবাদী ধর্ম ও সংস্কৃতির মোহ থেকে দলিত-বহুজনেরা যতদিন বের হতে না পারবে, ততোদিন তাদের উন্নতি ও মুক্তি ঘটা সম্ভব কি ? হে দলিত মূলনিবাসী মানুষ উত্তর দাও।
( লেখক -- প্রশান্ত রায় )
Post Top Ad
Your Ad Spot
Wednesday, March 7, 2018
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
Post Top Ad
Your Ad Spot
Author Details
Ut wisi enim ad minim veniam, quis nostrud exerci tation ullamcorper suscipit lobortis nisl ut aliquip ex ea commodo consequat. Duis autem vel eum iriure dolor in hendrerit in vulputate velit esse molestie consequat.
No comments:
Post a Comment