সাংবিধানিক স্বীকৃতিতেই কি আটকে
থাকবে সাঁওতালি ভাষা?
ড. জলধর কর্মকার
২২শে ডিসেম্বর ক্যালেন্ডারের একটি দিনমাত্র নয়। যদি ঐ দিন পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমান, বীরভূম, মালদহ, হুগলী প্রভৃতি জেলার সাঁওতাল পল্লিগুলিতে কানপাতা যায়, তাহলে শোনা যাবে কোনো এক সুপ্রাচীন জনজাতি কি অনির্বচনীয় আনন্দে, স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে দিনটি পালন করছেন তাঁদের প্রাণের প্রিয় ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতির দিন হিসেবে।
২০০৩ সালের ২২শে ডিসেম্বর সাঁওতালি ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগতে এক ঐতিহাসিক দিন। কারণ ঐ বিশেষ দিনেই পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন চারজন বিশিষ্ট বাম সাংসদ — বাসুদেব আচারিয়া, রূপচাঁদ মুরমু, ডাঃ রামচন্দ্র ডোম, অলকেশ দাস এবং অ্যাসেকার দু’জন প্রতিনিধি দুখিরাম হাঁসদা ও বিশিষ্ট সাঁওতাল বুদ্ধিজীবী ও গবেষক সুবোধ হাঁসদা — এই ছয়জন বাসুদেব আচারিয়ার নেতৃত্বে সাঁওতালি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে মিলিত হন। যুক্তিসম্মত নানান তর্ক-বিতর্কের পর দক্ষ সাংসদ বাসুদেব আচারিয়ার তীক্ষ্ণ যুক্তি বিন্যাস এবং সাঁওতালি ভাষার গবেষক সুবোধ হাঁসদার যুক্তি বাজপেয়ীজী মেনে নেন সাঁওতালি ভাষাকে সংবিধানের ৮ম তপসিলে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবকে। স্বাভাবিকভাবেই সাঁওতালি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি আদায়ের দিন হিসাবে দিনটি (২২শে ডিসেম্বর, ২০০৩) বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।১
সাঁওতালি এক অতি সুপ্রাচীন ভাষা। প্রায় ১২৭ কোটি মানুষের এই দেশে এক কোটিরও বেশি মানুষ কথা বলেন সাঁওতালিতে। সাঁওতালি জনসংখ্যার নিরিখে ভারতে এই ভাষার স্থান ১৩তম। বিশ্বের ৯৪তম স্থানে রয়েছে সাঁওতালির স্থান। অস্ট্রিক কোল বা খেরওয়াল ভাষা গোষ্ঠীর প্রধান প্রধান ভাষা সাঁওতালি, হো, কুরুখ, শবর প্রভৃতি হলেও একমাত্র সাঁওতালি ছাড়া বাকি সব ভাষাই অপসৃয়মান। ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশে আর্যভাষা আগমনের পূর্বে এ দেশের লোকেরা কোল বা অস্ট্রিক জাতীয় ভাষা এবং কতকটা দ্রাবিড় ভাষা ব্যবহার করত।’’ এই ভাষার ধ্বনি বিন্যাস, ব্যাকরণ অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ভারতবর্ষের চর্যাপদে, শ্রীকৃষ্ণকীর্তণ কাব্যে, মনসামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে সাঁওতালি শব্দের প্রচুর ব্যবহার রয়েছে। ভাষাবিদ্ তথা গবেষক ড. সুহৃদকুমার ভৌমিক প্রমুখ তাঁদের গবেষণালব্ধ দৃষ্টিতে একথা প্রমাণ করেছেন রবীন্দ্র সাহিত্য এমনকি সংস্কৃত সাহিত্য বহুভাবে সাঁওতালি ভাষার কাছে ঋণী। ভৌগোলিক কারণে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করলেও ভাষার মাধ্যমেই সুপ্রাচীন সাঁওতাল জাতি এক ও ঐক্যবদ্ধ থেকেছে।২
উনিশ শতকে রেনেসাঁ বা নবজাগরণের বিচিত্র তরঙ্গ অভিঘাতে ভারতবর্ষে ইংরেজি ভাষায় জ্ঞানচর্চার জোয়ারের সময়কালে স্বাদেশিক চেতনায় দৃপ্ত কিছু ভারতবাসীর মধ্যে দেখা দিয়েছিল মাতৃভাষার প্রতি প্রবল অনুরাগ।
ঠিক প্রায় একই সময়ে সাঁওতালি জগতেও মাঝি রামদাস টুডুর ‘খেরওয়াল বংশ : ধরমপুথি’ (আনুমানিক ১৮৯৭-৯৮), পাউল জুঝার (১৮৯২-১৯৫৪), সাধু রামচাঁদ মুরমু (১৮৯৭-১৯৫৪) প্রমুখের বিভিন্ন কালজয়ী রচনায় আমরা দেখি নিজেদের সাঁওতালি ভাষা-সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতিকে ধরে রাখার এক প্রবল আকুতি। কিন্তু সুনির্দিষ্ট এক লিপির অভাবে আসাম, বিহার, বেঙ্গল, ওডিশা এবং অন্যান্য প্রদেশে বসবাসরত সাঁওতাল জনজাতির ঐক্য চরমভাবে বিঘ্নিত হচ্ছিল। সর্বজনগ্রাহ্য নির্দিষ্ট কোনো লিপি না থাকায় আসামের সাঁওতালরা অসমিয়া লিপিতে, ওডিশার সাঁওতালরা ওডিশা লিপিতে, পশ্চিমবাংলার সাঁওতালরা বাংলা লিপিতে, হিন্দি বলয়ের সাঁওতাল লোকেরা দেবনাগরি লিপিতে আবার খ্রিস্টান মিশনারিরা রোমান হরফে সাঁওতালি ভাষাচর্চা করত। সুপ্রাচীন সাঁওতালদের নিজেদের যে লিপি ছিল না একথা সঠিক নয়। কেননা প্রাচীন সাঁওতালি লোকসংগীতে সাঁওতালদের লিপির উল্লেখ রয়েছে।
‘‘মুরমু ঠাকুরকো দ বাবা
পুথি বাবাকো পাড়হাও আ
বাদোলি-কঁয়ডা গাড়তে লিখন চালাঃ কান।’’
অর্থাৎ মুরমু ঠাকুররা পুঁথি পড়ে, বাদোলি কঁয়ড়া গাড় বা দূর্গে লেখন যায়। সাঁওতাল ভাষাবিদ ও সাহিত্যিক ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে প্রমুখর মতে সিন্ধুপ্রদেশে বসবাসকালে মুরমু গোত্রের লোকেদের উপর লিপি তৈরির ভার পড়েছিল। সাতজন বিজ্ঞ মুরমু মিলিতভাবে এই কাজ করেছিলেন। মহেঞ্জোদাড়োর লিপি পাঠোদ্ধার সম্ভব হলেই হয়তো বা অদূর ভবিষ্যতে এসব রহস্যের সমাধান হবে। যাই হোক বহিরাগত আর্যসহ, মাধো সিং প্রমুখ অন্যান্য ভাষাভাষী লোকেদের সাথে বারে বারে ভয়ানক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে মাঝে মাঝেই পরাজিত হয়ে তাদেরকে দুর্গম পাহাড়ে, পর্বতে, জঙ্গলে আশ্রয় নিতে হয়েছে। খেরওয়াল সভ্যতা ও সংস্কৃতির ঐ চরম বিপর্যয়ের দিনে জান প্রাণ দিয়ে তারা নিজের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে পারলেও পরিবর্তিত জীবনে লিপির প্রাসঙ্গিকতা অনুভবও করতে পারেননি বা রক্ষা করতেও পারেননি তাঁরা।৩
পরবর্তীকালে ১৯২৫ সালে ওডিশা রাজ্যের ময়ূরভঞ্জ জেলার ডাহারডি গ্রামের নন্দলাল ও সলমা মুরমুর সুপুত্র সাঁওতালি কবি, সাহিত্যিক ও নাট্যকার পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমু (১৯০৫-১৯৮২) ধ্বনি বিজ্ঞানের সমস্ত নিয়ম মেনে ‘অলচিকি’ লিপির আবিষ্কার করায় এবং পণ্ডিত মুরমুর ব্যক্তিগত উদ্যোগসহ তাঁর প্রতিষ্ঠিত দল অ্যাসেকার আন্দোলনের ফলে এই লিপি সমগ্র সাঁওতাল সমাজে এক সর্বজনগ্রাহ্য রূপ পায়। যদিও সাঁওতালি ভাষার লেখ্য রূপ কি হবে? অলচিকি? রোমান? দেবনগরী? বাংলা? না অন্য কিছু এ নিয়ে সাঁওতাল পণ্ডিত মহলে প্রবল বিতর্ক থেকেই যায়। ১৯৭১ সালে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকারের তৎকালীন মন্ত্রী অমিয় কিস্কু এই বিতর্কের অবসান ঘটাতে পারেননি, কারণ তিনি ছিলেন রোমান লিপির পক্ষে। এর আগে ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে সাঁওতাল জনজীবনে এক গণজাগরণ এলেও তৎকালীন বনমন্ত্রী এবং বাঁকুড়া জেলার আদিবাসী, মহাসভার সভাপতি ভবতোষ সরেনও এই সমস্যার সমাধানে বিফল হন। ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবাংলায় বামফ্রন্ট সরকারের আমলে জ্যোতি বসুর মুখ্যমন্ত্রিত্বে মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিকস্তরে শিক্ষানীতি ঘোষিত হয়। ১৯৭৯ সালের ৫ই জুলাই তৎকালীন পশ্চিমবাংলার বামফ্রন্ট সরকারই সর্বপ্রথম এক বিশেষ ঘোষণায় জানায় যে, ‘‘অলচিকি লিপিই হবে সাঁওতালি ভাষা শিক্ষার একমাত্র লিপি।’’
অলচিকি লিপির মান্যতা এবং সাঁওতালি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতির প্রশ্নে এর পরই প্রোথিত হতে থাকে এক একটি মাইল ফলক।
১৯৭৯ সালের ১৭ই নভেম্বর পশ্চিমবাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু পুরুলিয়া জেলার হুড়া ব্লকের কেঁদবনা ময়দানে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশে অলচিকি লিপির স্রষ্টা পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমুর হাতে তুলে দেন তাম্রফলক ও পুষ্পার্ঘ। পণ্ডিত মুরমু পশ্চিমবাংলাতেই প্রথম পান রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনা। উক্ত অনুষ্ঠানে অন্যান্য অতিথিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, আদিবাসী কল্যাণ বিভাগের মন্ত্রী ড. শম্ভুনাথ মাণ্ডি, বিধায়ক উপেন কিস্কু প্রমুখ।
১৯৮০-৯০-এর দশকে সাঁওতালিভাষী শিক্ষকদের অলচিকি লিপির প্রশিক্ষণ শুরু হয়। একই সাথে শুরু হয় অলচিকি লিপিতে প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক রচনার কাজ।
১৯৯৬-৯৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদে অন্তর্ভুক্ত করা হয় সাঁওতালি বুদ্ধিজীবীদের।
১৯৯৯ সালে পশ্চিমবাংলার তৎকালীন সময়কালের রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে একমাত্র সি পি আই (এম) দলই সাঁওতালি ভাষাকে সংবিধানের ৮ম তপসিলে অন্তর্ভুক্ত করার দাবিকে তাদের নির্বাচনী ইশ্তেহারে অন্তর্ভুক্ত করে এই দাবিকে রাজনৈতিক দাবির মর্যাদা দেয়।
২০০০ সালের ১লা আগস্ট পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় সাঁওতালি ভাষাকে সংবিধানের ৮ম তপসিলে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি।
২০০০ সালের ২২শে আগস্ট অনগ্রসর সম্প্রদায় কল্যাণ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী উপেন কিস্কুর নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সর্বদলীয় প্রতিনিধি দল তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদবানি মহাশয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সাঁওতালি ভাষাকে অবিলম্বে সংবিধানের ৮ম তপসিলে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়ে স্মারকলিপি দেন।
২০০১ সালে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক পবিত্র সরকারকে চেয়ারম্যান করে তৈরি হয় সাঁওতালি ভাষা কমিটি।
২০০৩ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর অ্যাসেকার ডাকে কলকাতার রানি রাসমণি রোডে প্রায় দুই লক্ষাধিক সাঁওতাল জনগণের বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ থেকে সাঁওতালি ভাষাকে সংবিধানের ৮ম তপসিলে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল, প্রধানমন্ত্রী এবং রাজ্যপালের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিকে স্মারকলিপি জমা দেওয়া হয়।
২০০৩ সালের ২০শে ডিসেম্বর কেন্দ্রের সাথে বৈঠকে মন্ত্রী উপেন কিস্কু সাঁওতালি ভাষার স্বীকৃতির জোরদার দাবি জানান।
২০০৩ সালে সাঁওতালি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতির পর একে একে তেরোটি বছর অতিক্রান্ত হতে চলল। ইতিমধ্যে ২০১১ সালে পশ্চিমবাংলায় ঘটে গেছে রাজনৈতিক পালা বদল। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার। উল্লেখ্য এই সময়কালে ৩০শে জুন হুল দিবসের দিনে সিধু কানুর মূর্তিতে মালা দেওয়ার পর ডহরকেও খুঁজে বেড়ানো হয় মালা দেওয়ার জন্য। ‘হুল দিবসে’র সংগ্রামী দিনটিকে চালানো হয় সিধু কানু বিরসার জন্মদিন হিসাবে। সাঁওতালি ভাষা-সাহিত্য চর্চার জন্য বিগত দিনে ২০০৪ সালে গঠিত হয়েছিল ‘পশ্চিমবঙ্গ সানতালি অ্যাকাডেমি’। এখান থেকেই প্রকাশিত হতো ‘দিশা’’ নামে একটি সাঁওতালি পত্রিকা - যার মধ্যে থাকত সাঁওতাল জনজীবনের বিভিন্ন আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা। সুপ্রাচীন সাঁওতাল জাতির সমাজ-সংস্কৃতি এবং শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে যাওয়ার দিশা দেখাত ‘দিশা’। এছাড়াও ১৯৫৬ সাল থেকে রাজ্যস্তর থেকেই প্রকাশিত হতো ‘‘পশ্ছিমবাংলা’’ পত্রিকা। খেলা-মেলার বাস্তবতায় এসবকিছুই এখন বন্ধ। এই সরকার ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পরই ২০১২ সালের এক আইনে ঘোষণা করেছিল —
১) রাজ্যের যে সমস্ত জেলায় কিংবা ব্লকগুলিতে ন্যূনতম ১০শতাংশ লোক সাঁওতালিতে কথা বলেন সেই ব্লক বা জেলার সরকারি কাজে সেখানকার স্থানীয় ভাষাকে ব্যবহার করা হবে।
২) বিরসা মুণ্ডা আকাডেমি এবং সিধু কানু আকাডেমি গঠন করা হবে।
৩) বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমস্ত রচনাকে সাঁওতালিতে তর্জমা করে প্রকাশ করা হবে।
৪) ৯০০ বিদ্যালয়ে ১৮০০ সাঁওতালি শিক্ষক নিয়োগ করা হবে।
কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল উপরোক্ত প্রতিশ্রুতি পালন করা তো দূরের কথা বরঞ্চ সম্প্রতি দেখা গেছে বাঁকুডা জেলায় ১৪টি স্কুলে ৬৮জন প্যারাটিচার ২০১২ সাল থেকে কোন বেতনই পাননি। শুধু তাই নয় আদিবাসী লেখক ও সাহিত্যিকদের উৎসাহিত করার জন্য আদিবাসী ভাষা-সংস্কৃতির প্রাণপুরুষ সাধু রামচাঁদ মুরমু, পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমু, লাল শুকরা ওরাঁও এবং কবি সারদাপ্রসাদ কিস্কু নামাঙ্কিত যে স্মৃতি পুরস্কারগুলি দেওয়া হতো বর্তমানে সবকিছুই বন্ধ। ২০১৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ সান্তালি অ্যাকাডেমির কমিটি পুনর্গঠিত হলেও কেবলমাত্র কমিটি ভাঙাগড়ার কাজই চলছে।
এ রাজ্যের জঙ্গলমহলের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর এবং অন্যান্য জেলায় সাঁওতালি ভাষায় বহু স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়েই পঠনপাঠন চলছে একথা সত্য। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সাঁওতালি ভাষায় লিখতে ও পড়তে জানেন এরকম সান্তালি প্যারাটিচার পুরুলিয়া জেলাতে নিযুক্ত হয়েছেন ৩৭জন। বাঁকুড়া জেলায় ১৪টি বিদ্যালয়ে ৬জন করে মোট ৮৪জন। একইভাবে পশ্চিম মেদিনীপুরেও বেশ কিছু সাঁওতালি শিক্ষক নিযুক্ত হয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অধীন এই বিদ্যালয়গুলিতে প্রথম ভাষায় বাংলার বদলে সাঁওতালি পড়ার সুযোগ রয়েছে। একইভাবে উচ্চ মাধ্যমিক কাউন্সিলের অধীনেও একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ১ম ভাষা হিসেবে সাঁওতালি পড়া যায়। যে-কোনো বিদ্যালয়ের এম সি বা পরিচালন সমিতি সিদ্ধান্ত নিয়ে মধ্যশিক্ষা পর্ষদে আবেদন জানালে বাংলার বদলে সাঁওতালি বিষয়টি পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে ঐ জেলার ডি আই-র কোনো অনুমোদন লাগে না। এম সি-র রেজুলিউশন সহ ঐ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বা শিক্ষিকা সরাসরি শিক্ষা দপ্তরের সচিবের কাছে আবেদন জানালেই এই বিষয়টি পাওয়া যায়। এবার ঐ বিষয়টি পাওয়ার পর ডি আই-র মাধ্যমে ডিরেকটর অব স্কুল এডুকেশন বা ডি এস সি-তে যোগাযোগ করতে হয় স্থায়ী শিক্ষক পাওয়ার জন্য। চিফ সেক্রেটারি-র সই হয়ে গেলে তা যায় এস এস সি-তে শিক্ষক পাওয়ার জন্য। এক্ষেত্রে মজার বিষয় হলো - বিষয়টি মঞ্জুর করছে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ কিন্তু পোস্ট দেবে এস এস সি। প্রশাসনিক এই জটিলতায় বিগত পাঁচ বছরে সান্তালির কোনো পোস্ট মঞ্জুরই হয়নি। একই জটিলতা রয়েছে উচ্চমাধ্যমিকে সাঁওতালি পড়ার ক্ষেত্রেও।
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করা গেছে পুরুলিয়া জেলায় সিধু কানু বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এগারোটি কলেজে, পশ্চিম মেদিনীপুরের বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বারোটি কলেজে, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন দশটি কলেজে এবং বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সাঁওতালি ভাষায় পঠন-পাঠনের সুযোগ প্রসারিত হলেও মঞ্জুরিকৃত সাঁওতালি অধ্যাপকের পদ না থাকায় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক থাকায় সাঁওতালি ভাষা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হচ্ছে। উপযুক্ত অধ্যাপক না থাকায় ছেলেমেয়েরাও সাঁওতালি পড়তে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। শিক্ষার প্রাথমিক স্তরেও দেখা যাচ্ছে বিদ্যালয়গুলিতে নিযুক্ত প্যারাটিচাররা কি পড়াবেন? কতটা পড়াবেন? এ সব বিষয়ে নির্দিষ্ট নির্দেশিকা না থাকায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাঁরাও সাঁওতালি মাধ্যমে না পড়িয়ে বাংলা মাধ্যমের গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসাচ্ছেন। এর ফলশ্রুতিতে প্রাথমিকস্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়স্তর পর্যন্ত সাঁওতালি ভাষায় অলচিকি হরফে পঠন-পাঠনের দীর্ঘদিনের দাবি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হচ্ছে।
যে-কোন ভাষার বিকাশের ক্ষেত্রে একটি সহজ প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। সেটা হলো কোন্ ভাষাকে আমরা সমৃদ্ধ বলব? এর সহজ-সরল উত্তর হলো যে ভাষার মধ্যে যত বড় সাহিত্য রয়েছে, প্রেস এবং ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় ঐ ভাষা কতটা প্রযুক্ত হচ্ছে, জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে ঐ ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা, অফিস আদালতে ঐ ভাষার মান্যতা কতখানি? এসব কিছুর উপরই নির্ভর করছে যে-কোন ভাষার সমৃদ্ধি। সাঁওতালি ভাষাকে এই পর্যায়ে আমরা কতটা আনতে পেরেছি? তাই সাঁওতালিকেও এই পর্যায়ে নিয়ে আসার প্রধান দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকেই। সাময়িক কিছু প্যারাটিচার নিয়োগ করলেই কিংবা কিছু স্কুল-কলেজে সাঁওতালি চালু করে দিলেই কোনো একটি ভাষার যথাযথ বিকাশ হয় না। রাজনৈতিক বৃত্তের ঊর্ধ্বে উঠে যথার্থ মতামতের ভিত্তিতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজন। ওডিশার আদিবাসী সাঁওতা সেচেৎ লাকচার সেমনেৎ-এর এক বার্ষিক সভায় সাঁওতাল জনগণের প্রতি অলচিকির স্রষ্টা পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমু একবার বলেছিলেন, ‘‘শোষিত, নিপীড়িত ও ছিন্নবিচ্ছিন্ন খেরওয়াল সমাজের মানুষ হিসাবে আমরা যদি নির্দিষ্ট পথে না চলি এবং নির্দিষ্ট হরফে আমাদের ইতিহাস লিখে না যাই, তাহলে আমাদের ঐতিহ্য আগামী প্রজন্মের কাছে কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। বিভিন্ন প্রদেশে বিমাতাসুলভ ভাষায় শিক্ষিত আদিবাসী মানুষ কোনোদিনও তাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় অনুশাসনের সমন্বয়সাধন করতে পারবে না। এজন্য প্রয়োজন বিভিন্ন প্রদেশের আদিবাসী ভাইবোনদের অলচিকি লিপির মাধ্যমে সে সব চর্চা করা।’’ সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই সাঁওতালি ভাষা তথা অলচিকির বিস্তারে সাঁওতাল বুদ্ধিজীবীদের এগিয়ে আসাটা আজ সবচেয়ে জরুরি।
যে-কোনো জাতির মর্যাদা ও ঐক্য রাখার প্রধান সেতুবন্ধন হলো ভাষা। ভাষাচার্য ড. সুকুমার সেন বলেছেন, ‘‘ভাষা নিয়ে জাতি, জাতি নিয়ে দেশ’’। (বঙ্গ ভূমিকা-পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা - ৩) এই অন্তরতম সত্যকেই বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ মনীষী গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। একইভাবে সাঁওতাল জাতিকে ঐ সত্য অবলম্বন করেই ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন সাধু রামচাঁদ মুরমু, পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমু প্রমুখ সাঁওতাল ভাষাবিদ্। ভৌগোলিক কারণে এক সময়কার ছিন্নভিন্ন সাঁওতাল জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য পণ্ডিত মুরমু তাই বলেছিলেন —
‘‘অল মেনাঃ তামা/বড় মেনাঃ তামা
ধরম মেনাঃ তামা/আমহঁ মেনাম।
অলেম আদ্লেরে/রড়েম আদ্লেরে
ধরমেম আদ্লেরে/আম হুঁম আদঃ।’’
বাংলা অর্থ — আছে তোমার বর্ণমালা/আছে তোমার ভাষা,
আছে তোমার ধর্ম, জীবনেরই আশা।
হারিয়ে গেলে ভাষা তোমার/হারিয়ে গেলে বর্ণ,
নিজেই তুমি হারিয়ে যাবে/হারিয়ে গেলে ধর্ম।
(বাংলা কাব্যরূপ — শ্রী সুবোধ হাঁসদা)
আমাদের দেশ ভারতবর্ষে সব মিলিয়ে ধরলে মোট ভাষার সংখ্যা প্রায় ২১৬টি। সারা পৃথিবীকে এক ছাতার তলায় আনতে গিয়ে অতিদ্রুত আঞ্চলিক ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বৈচিত্রময় রূপগুলি ঢুকে যাচ্ছে ময়দানবের গুহায়। প্রাচীন ভারতের খেরওয়াল গোষ্ঠীর মুণ্ডারি, হো, কুরুখ, শবরসহ চোদ্দ-পনেরোটি শাখার অবস্থা বিপাকে, ইতিমধ্যেই নিরুপায়ভাবে আত্মসমর্পণ করেছে এদেশের আর্য বা তার শাখা ভাষা গোষ্ঠীর কাছে। ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম সাঁওতাল জাতি ও সাঁওতালি ভাষা। তাই আদিবাসী, অ-আদিবাসী সবার মিলিত কণ্ঠ হোক—আমরা হারিয়ে যেতে দেবো না এক সুপ্রাচীন ভাষাকে। সরকারি-বেসরকারি সকলের মিলিত উদ্যোগে নিজস্ব প্রাণশক্তির দুর্দমনীয় তেজে ক্রমশ ঐশ্বর্যশালিনী হোক সাঁওতালি ভাষা। ২২শে ডিসেম্বর সাঁওতালি ভাষার স্বীকৃতি দিবসে এটাই হোক আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার।
(লেখক পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী ও লোকশিল্পী সংঘের পুরুলিয়া জেলা সম্পাদক এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাঁওতালি সমাজ ও সংস্কৃতির গবেষক)
তথ্যসূত্র ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার —
১) ড. শান্তি সিংহ, রঘুনাথ মুরমু সাঁওতালি সাহিত্য ও অলচিকি আন্দোলন, পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমু জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন কমিটি, ডিসেম্বর ২০০৪।
২। ড. জলধর কর্মকারের গবেষণাপত্র।
৩। সাঁওতালি ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস—ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে, বাস্কে পাবলিকেশন, কলকাতা-৯, জুন ১৯৯৯।
৪। সুবোধ হাঁসদার প্রবন্ধ — স্মরণিকা, পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমুর জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন ২০০৫।
৫। কান্তি বিশ্বাসের প্রবন্ধ স্মরণিকা, সাঁওতালি ভাষার আন্তর্জাতিক সম্মেলন, ২০০৫, পশ্চিমবঙ্গ সান্তালি অ্যাকাডেমি।
৬। বিশেষ সাক্ষাৎকার-মহাদেব হাঁসদা, সম্পাদক তেতরে ও সাঁওতালি ভাষা শিক্ষক।
৭। বিশেষ সাক্ষাৎকার – নবীন বেসরা, কবি সাহিত্যিক ও সাঁওতালি ভাষা শিক্ষক।
সাংবিধানিক স্বীকৃতিতেই কি আটকে
থাকবে সাঁওতালি ভাষা?
ড. জলধর কর্মকার
২২শে ডিসেম্বর ক্যালেন্ডারের একটি দিনমাত্র নয়। যদি ঐ দিন পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমান, বীরভূম, মালদহ, হুগলী প্রভৃতি জেলার সাঁওতাল পল্লিগুলিতে কানপাতা যায়, তাহলে শোনা যাবে কোনো এক সুপ্রাচীন জনজাতি কি অনির্বচনীয় আনন্দে, স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে দিনটি পালন করছেন তাঁদের প্রাণের প্রিয় ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতির দিন হিসেবে।
২০০৩ সালের ২২শে ডিসেম্বর সাঁওতালি ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগতে এক ঐতিহাসিক দিন। কারণ ঐ বিশেষ দিনেই পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন চারজন বিশিষ্ট বাম সাংসদ — বাসুদেব আচারিয়া, রূপচাঁদ মুরমু, ডাঃ রামচন্দ্র ডোম, অলকেশ দাস এবং অ্যাসেকার দু’জন প্রতিনিধি দুখিরাম হাঁসদা ও বিশিষ্ট সাঁওতাল বুদ্ধিজীবী ও গবেষক সুবোধ হাঁসদা — এই ছয়জন বাসুদেব আচারিয়ার নেতৃত্বে সাঁওতালি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে মিলিত হন। যুক্তিসম্মত নানান তর্ক-বিতর্কের পর দক্ষ সাংসদ বাসুদেব আচারিয়ার তীক্ষ্ণ যুক্তি বিন্যাস এবং সাঁওতালি ভাষার গবেষক সুবোধ হাঁসদার যুক্তি বাজপেয়ীজী মেনে নেন সাঁওতালি ভাষাকে সংবিধানের ৮ম তপসিলে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবকে। স্বাভাবিকভাবেই সাঁওতালি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি আদায়ের দিন হিসাবে দিনটি (২২শে ডিসেম্বর, ২০০৩) বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।১
সাঁওতালি এক অতি সুপ্রাচীন ভাষা। প্রায় ১২৭ কোটি মানুষের এই দেশে এক কোটিরও বেশি মানুষ কথা বলেন সাঁওতালিতে। সাঁওতালি জনসংখ্যার নিরিখে ভারতে এই ভাষার স্থান ১৩তম। বিশ্বের ৯৪তম স্থানে রয়েছে সাঁওতালির স্থান। অস্ট্রিক কোল বা খেরওয়াল ভাষা গোষ্ঠীর প্রধান প্রধান ভাষা সাঁওতালি, হো, কুরুখ, শবর প্রভৃতি হলেও একমাত্র সাঁওতালি ছাড়া বাকি সব ভাষাই অপসৃয়মান। ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশে আর্যভাষা আগমনের পূর্বে এ দেশের লোকেরা কোল বা অস্ট্রিক জাতীয় ভাষা এবং কতকটা দ্রাবিড় ভাষা ব্যবহার করত।’’ এই ভাষার ধ্বনি বিন্যাস, ব্যাকরণ অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ভারতবর্ষের চর্যাপদে, শ্রীকৃষ্ণকীর্তণ কাব্যে, মনসামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে সাঁওতালি শব্দের প্রচুর ব্যবহার রয়েছে। ভাষাবিদ্ তথা গবেষক ড. সুহৃদকুমার ভৌমিক প্রমুখ তাঁদের গবেষণালব্ধ দৃষ্টিতে একথা প্রমাণ করেছেন রবীন্দ্র সাহিত্য এমনকি সংস্কৃত সাহিত্য বহুভাবে সাঁওতালি ভাষার কাছে ঋণী। ভৌগোলিক কারণে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করলেও ভাষার মাধ্যমেই সুপ্রাচীন সাঁওতাল জাতি এক ও ঐক্যবদ্ধ থেকেছে।২
উনিশ শতকে রেনেসাঁ বা নবজাগরণের বিচিত্র তরঙ্গ অভিঘাতে ভারতবর্ষে ইংরেজি ভাষায় জ্ঞানচর্চার জোয়ারের সময়কালে স্বাদেশিক চেতনায় দৃপ্ত কিছু ভারতবাসীর মধ্যে দেখা দিয়েছিল মাতৃভাষার প্রতি প্রবল অনুরাগ।
ঠিক প্রায় একই সময়ে সাঁওতালি জগতেও মাঝি রামদাস টুডুর ‘খেরওয়াল বংশ : ধরমপুথি’ (আনুমানিক ১৮৯৭-৯৮), পাউল জুঝার (১৮৯২-১৯৫৪), সাধু রামচাঁদ মুরমু (১৮৯৭-১৯৫৪) প্রমুখের বিভিন্ন কালজয়ী রচনায় আমরা দেখি নিজেদের সাঁওতালি ভাষা-সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতিকে ধরে রাখার এক প্রবল আকুতি। কিন্তু সুনির্দিষ্ট এক লিপির অভাবে আসাম, বিহার, বেঙ্গল, ওডিশা এবং অন্যান্য প্রদেশে বসবাসরত সাঁওতাল জনজাতির ঐক্য চরমভাবে বিঘ্নিত হচ্ছিল। সর্বজনগ্রাহ্য নির্দিষ্ট কোনো লিপি না থাকায় আসামের সাঁওতালরা অসমিয়া লিপিতে, ওডিশার সাঁওতালরা ওডিশা লিপিতে, পশ্চিমবাংলার সাঁওতালরা বাংলা লিপিতে, হিন্দি বলয়ের সাঁওতাল লোকেরা দেবনাগরি লিপিতে আবার খ্রিস্টান মিশনারিরা রোমান হরফে সাঁওতালি ভাষাচর্চা করত। সুপ্রাচীন সাঁওতালদের নিজেদের যে লিপি ছিল না একথা সঠিক নয়। কেননা প্রাচীন সাঁওতালি লোকসংগীতে সাঁওতালদের লিপির উল্লেখ রয়েছে।
‘‘মুরমু ঠাকুরকো দ বাবা
পুথি বাবাকো পাড়হাও আ
বাদোলি-কঁয়ডা গাড়তে লিখন চালাঃ কান।’’
অর্থাৎ মুরমু ঠাকুররা পুঁথি পড়ে, বাদোলি কঁয়ড়া গাড় বা দূর্গে লেখন যায়। সাঁওতাল ভাষাবিদ ও সাহিত্যিক ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে প্রমুখর মতে সিন্ধুপ্রদেশে বসবাসকালে মুরমু গোত্রের লোকেদের উপর লিপি তৈরির ভার পড়েছিল। সাতজন বিজ্ঞ মুরমু মিলিতভাবে এই কাজ করেছিলেন। মহেঞ্জোদাড়োর লিপি পাঠোদ্ধার সম্ভব হলেই হয়তো বা অদূর ভবিষ্যতে এসব রহস্যের সমাধান হবে। যাই হোক বহিরাগত আর্যসহ, মাধো সিং প্রমুখ অন্যান্য ভাষাভাষী লোকেদের সাথে বারে বারে ভয়ানক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে মাঝে মাঝেই পরাজিত হয়ে তাদেরকে দুর্গম পাহাড়ে, পর্বতে, জঙ্গলে আশ্রয় নিতে হয়েছে। খেরওয়াল সভ্যতা ও সংস্কৃতির ঐ চরম বিপর্যয়ের দিনে জান প্রাণ দিয়ে তারা নিজের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে পারলেও পরিবর্তিত জীবনে লিপির প্রাসঙ্গিকতা অনুভবও করতে পারেননি বা রক্ষা করতেও পারেননি তাঁরা।৩
পরবর্তীকালে ১৯২৫ সালে ওডিশা রাজ্যের ময়ূরভঞ্জ জেলার ডাহারডি গ্রামের নন্দলাল ও সলমা মুরমুর সুপুত্র সাঁওতালি কবি, সাহিত্যিক ও নাট্যকার পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমু (১৯০৫-১৯৮২) ধ্বনি বিজ্ঞানের সমস্ত নিয়ম মেনে ‘অলচিকি’ লিপির আবিষ্কার করায় এবং পণ্ডিত মুরমুর ব্যক্তিগত উদ্যোগসহ তাঁর প্রতিষ্ঠিত দল অ্যাসেকার আন্দোলনের ফলে এই লিপি সমগ্র সাঁওতাল সমাজে এক সর্বজনগ্রাহ্য রূপ পায়। যদিও সাঁওতালি ভাষার লেখ্য রূপ কি হবে? অলচিকি? রোমান? দেবনগরী? বাংলা? না অন্য কিছু এ নিয়ে সাঁওতাল পণ্ডিত মহলে প্রবল বিতর্ক থেকেই যায়। ১৯৭১ সালে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকারের তৎকালীন মন্ত্রী অমিয় কিস্কু এই বিতর্কের অবসান ঘটাতে পারেননি, কারণ তিনি ছিলেন রোমান লিপির পক্ষে। এর আগে ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে সাঁওতাল জনজীবনে এক গণজাগরণ এলেও তৎকালীন বনমন্ত্রী এবং বাঁকুড়া জেলার আদিবাসী, মহাসভার সভাপতি ভবতোষ সরেনও এই সমস্যার সমাধানে বিফল হন। ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবাংলায় বামফ্রন্ট সরকারের আমলে জ্যোতি বসুর মুখ্যমন্ত্রিত্বে মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিকস্তরে শিক্ষানীতি ঘোষিত হয়। ১৯৭৯ সালের ৫ই জুলাই তৎকালীন পশ্চিমবাংলার বামফ্রন্ট সরকারই সর্বপ্রথম এক বিশেষ ঘোষণায় জানায় যে, ‘‘অলচিকি লিপিই হবে সাঁওতালি ভাষা শিক্ষার একমাত্র লিপি।’’
অলচিকি লিপির মান্যতা এবং সাঁওতালি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতির প্রশ্নে এর পরই প্রোথিত হতে থাকে এক একটি মাইল ফলক।
১৯৭৯ সালের ১৭ই নভেম্বর পশ্চিমবাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু পুরুলিয়া জেলার হুড়া ব্লকের কেঁদবনা ময়দানে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশে অলচিকি লিপির স্রষ্টা পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমুর হাতে তুলে দেন তাম্রফলক ও পুষ্পার্ঘ। পণ্ডিত মুরমু পশ্চিমবাংলাতেই প্রথম পান রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনা। উক্ত অনুষ্ঠানে অন্যান্য অতিথিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, আদিবাসী কল্যাণ বিভাগের মন্ত্রী ড. শম্ভুনাথ মাণ্ডি, বিধায়ক উপেন কিস্কু প্রমুখ।
১৯৮০-৯০-এর দশকে সাঁওতালিভাষী শিক্ষকদের অলচিকি লিপির প্রশিক্ষণ শুরু হয়। একই সাথে শুরু হয় অলচিকি লিপিতে প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক রচনার কাজ।
১৯৯৬-৯৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদে অন্তর্ভুক্ত করা হয় সাঁওতালি বুদ্ধিজীবীদের।
১৯৯৯ সালে পশ্চিমবাংলার তৎকালীন সময়কালের রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে একমাত্র সি পি আই (এম) দলই সাঁওতালি ভাষাকে সংবিধানের ৮ম তপসিলে অন্তর্ভুক্ত করার দাবিকে তাদের নির্বাচনী ইশ্তেহারে অন্তর্ভুক্ত করে এই দাবিকে রাজনৈতিক দাবির মর্যাদা দেয়।
২০০০ সালের ১লা আগস্ট পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় সাঁওতালি ভাষাকে সংবিধানের ৮ম তপসিলে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি।
২০০০ সালের ২২শে আগস্ট অনগ্রসর সম্প্রদায় কল্যাণ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী উপেন কিস্কুর নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সর্বদলীয় প্রতিনিধি দল তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদবানি মহাশয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সাঁওতালি ভাষাকে অবিলম্বে সংবিধানের ৮ম তপসিলে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়ে স্মারকলিপি দেন।
২০০১ সালে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক পবিত্র সরকারকে চেয়ারম্যান করে তৈরি হয় সাঁওতালি ভাষা কমিটি।
২০০৩ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর অ্যাসেকার ডাকে কলকাতার রানি রাসমণি রোডে প্রায় দুই লক্ষাধিক সাঁওতাল জনগণের বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ থেকে সাঁওতালি ভাষাকে সংবিধানের ৮ম তপসিলে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল, প্রধানমন্ত্রী এবং রাজ্যপালের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিকে স্মারকলিপি জমা দেওয়া হয়।
২০০৩ সালের ২০শে ডিসেম্বর কেন্দ্রের সাথে বৈঠকে মন্ত্রী উপেন কিস্কু সাঁওতালি ভাষার স্বীকৃতির জোরদার দাবি জানান।
২০০৩ সালে সাঁওতালি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতির পর একে একে তেরোটি বছর অতিক্রান্ত হতে চলল। ইতিমধ্যে ২০১১ সালে পশ্চিমবাংলায় ঘটে গেছে রাজনৈতিক পালা বদল। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার। উল্লেখ্য এই সময়কালে ৩০শে জুন হুল দিবসের দিনে সিধু কানুর মূর্তিতে মালা দেওয়ার পর ডহরকেও খুঁজে বেড়ানো হয় মালা দেওয়ার জন্য। ‘হুল দিবসে’র সংগ্রামী দিনটিকে চালানো হয় সিধু কানু বিরসার জন্মদিন হিসাবে। সাঁওতালি ভাষা-সাহিত্য চর্চার জন্য বিগত দিনে ২০০৪ সালে গঠিত হয়েছিল ‘পশ্চিমবঙ্গ সানতালি অ্যাকাডেমি’। এখান থেকেই প্রকাশিত হতো ‘দিশা’’ নামে একটি সাঁওতালি পত্রিকা - যার মধ্যে থাকত সাঁওতাল জনজীবনের বিভিন্ন আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা। সুপ্রাচীন সাঁওতাল জাতির সমাজ-সংস্কৃতি এবং শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে যাওয়ার দিশা দেখাত ‘দিশা’। এছাড়াও ১৯৫৬ সাল থেকে রাজ্যস্তর থেকেই প্রকাশিত হতো ‘‘পশ্ছিমবাংলা’’ পত্রিকা। খেলা-মেলার বাস্তবতায় এসবকিছুই এখন বন্ধ। এই সরকার ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পরই ২০১২ সালের এক আইনে ঘোষণা করেছিল —
১) রাজ্যের যে সমস্ত জেলায় কিংবা ব্লকগুলিতে ন্যূনতম ১০শতাংশ লোক সাঁওতালিতে কথা বলেন সেই ব্লক বা জেলার সরকারি কাজে সেখানকার স্থানীয় ভাষাকে ব্যবহার করা হবে।
২) বিরসা মুণ্ডা আকাডেমি এবং সিধু কানু আকাডেমি গঠন করা হবে।
৩) বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমস্ত রচনাকে সাঁওতালিতে তর্জমা করে প্রকাশ করা হবে।
৪) ৯০০ বিদ্যালয়ে ১৮০০ সাঁওতালি শিক্ষক নিয়োগ করা হবে।
কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল উপরোক্ত প্রতিশ্রুতি পালন করা তো দূরের কথা বরঞ্চ সম্প্রতি দেখা গেছে বাঁকুডা জেলায় ১৪টি স্কুলে ৬৮জন প্যারাটিচার ২০১২ সাল থেকে কোন বেতনই পাননি। শুধু তাই নয় আদিবাসী লেখক ও সাহিত্যিকদের উৎসাহিত করার জন্য আদিবাসী ভাষা-সংস্কৃতির প্রাণপুরুষ সাধু রামচাঁদ মুরমু, পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমু, লাল শুকরা ওরাঁও এবং কবি সারদাপ্রসাদ কিস্কু নামাঙ্কিত যে স্মৃতি পুরস্কারগুলি দেওয়া হতো বর্তমানে সবকিছুই বন্ধ। ২০১৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ সান্তালি অ্যাকাডেমির কমিটি পুনর্গঠিত হলেও কেবলমাত্র কমিটি ভাঙাগড়ার কাজই চলছে।
এ রাজ্যের জঙ্গলমহলের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর এবং অন্যান্য জেলায় সাঁওতালি ভাষায় বহু স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়েই পঠনপাঠন চলছে একথা সত্য। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সাঁওতালি ভাষায় লিখতে ও পড়তে জানেন এরকম সান্তালি প্যারাটিচার পুরুলিয়া জেলাতে নিযুক্ত হয়েছেন ৩৭জন। বাঁকুড়া জেলায় ১৪টি বিদ্যালয়ে ৬জন করে মোট ৮৪জন। একইভাবে পশ্চিম মেদিনীপুরেও বেশ কিছু সাঁওতালি শিক্ষক নিযুক্ত হয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অধীন এই বিদ্যালয়গুলিতে প্রথম ভাষায় বাংলার বদলে সাঁওতালি পড়ার সুযোগ রয়েছে। একইভাবে উচ্চ মাধ্যমিক কাউন্সিলের অধীনেও একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ১ম ভাষা হিসেবে সাঁওতালি পড়া যায়। যে-কোনো বিদ্যালয়ের এম সি বা পরিচালন সমিতি সিদ্ধান্ত নিয়ে মধ্যশিক্ষা পর্ষদে আবেদন জানালে বাংলার বদলে সাঁওতালি বিষয়টি পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে ঐ জেলার ডি আই-র কোনো অনুমোদন লাগে না। এম সি-র রেজুলিউশন সহ ঐ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বা শিক্ষিকা সরাসরি শিক্ষা দপ্তরের সচিবের কাছে আবেদন জানালেই এই বিষয়টি পাওয়া যায়। এবার ঐ বিষয়টি পাওয়ার পর ডি আই-র মাধ্যমে ডিরেকটর অব স্কুল এডুকেশন বা ডি এস সি-তে যোগাযোগ করতে হয় স্থায়ী শিক্ষক পাওয়ার জন্য। চিফ সেক্রেটারি-র সই হয়ে গেলে তা যায় এস এস সি-তে শিক্ষক পাওয়ার জন্য। এক্ষেত্রে মজার বিষয় হলো - বিষয়টি মঞ্জুর করছে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ কিন্তু পোস্ট দেবে এস এস সি। প্রশাসনিক এই জটিলতায় বিগত পাঁচ বছরে সান্তালির কোনো পোস্ট মঞ্জুরই হয়নি। একই জটিলতা রয়েছে উচ্চমাধ্যমিকে সাঁওতালি পড়ার ক্ষেত্রেও।
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করা গেছে পুরুলিয়া জেলায় সিধু কানু বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এগারোটি কলেজে, পশ্চিম মেদিনীপুরের বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বারোটি কলেজে, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন দশটি কলেজে এবং বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সাঁওতালি ভাষায় পঠন-পাঠনের সুযোগ প্রসারিত হলেও মঞ্জুরিকৃত সাঁওতালি অধ্যাপকের পদ না থাকায় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক থাকায় সাঁওতালি ভাষা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হচ্ছে। উপযুক্ত অধ্যাপক না থাকায় ছেলেমেয়েরাও সাঁওতালি পড়তে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। শিক্ষার প্রাথমিক স্তরেও দেখা যাচ্ছে বিদ্যালয়গুলিতে নিযুক্ত প্যারাটিচাররা কি পড়াবেন? কতটা পড়াবেন? এ সব বিষয়ে নির্দিষ্ট নির্দেশিকা না থাকায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাঁরাও সাঁওতালি মাধ্যমে না পড়িয়ে বাংলা মাধ্যমের গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসাচ্ছেন। এর ফলশ্রুতিতে প্রাথমিকস্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়স্তর পর্যন্ত সাঁওতালি ভাষায় অলচিকি হরফে পঠন-পাঠনের দীর্ঘদিনের দাবি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হচ্ছে।
যে-কোন ভাষার বিকাশের ক্ষেত্রে একটি সহজ প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। সেটা হলো কোন্ ভাষাকে আমরা সমৃদ্ধ বলব? এর সহজ-সরল উত্তর হলো যে ভাষার মধ্যে যত বড় সাহিত্য রয়েছে, প্রেস এবং ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় ঐ ভাষা কতটা প্রযুক্ত হচ্ছে, জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে ঐ ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা, অফিস আদালতে ঐ ভাষার মান্যতা কতখানি? এসব কিছুর উপরই নির্ভর করছে যে-কোন ভাষার সমৃদ্ধি। সাঁওতালি ভাষাকে এই পর্যায়ে আমরা কতটা আনতে পেরেছি? তাই সাঁওতালিকেও এই পর্যায়ে নিয়ে আসার প্রধান দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকেই। সাময়িক কিছু প্যারাটিচার নিয়োগ করলেই কিংবা কিছু স্কুল-কলেজে সাঁওতালি চালু করে দিলেই কোনো একটি ভাষার যথাযথ বিকাশ হয় না। রাজনৈতিক বৃত্তের ঊর্ধ্বে উঠে যথার্থ মতামতের ভিত্তিতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজন। ওডিশার আদিবাসী সাঁওতা সেচেৎ লাকচার সেমনেৎ-এর এক বার্ষিক সভায় সাঁওতাল জনগণের প্রতি অলচিকির স্রষ্টা পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমু একবার বলেছিলেন, ‘‘শোষিত, নিপীড়িত ও ছিন্নবিচ্ছিন্ন খেরওয়াল সমাজের মানুষ হিসাবে আমরা যদি নির্দিষ্ট পথে না চলি এবং নির্দিষ্ট হরফে আমাদের ইতিহাস লিখে না যাই, তাহলে আমাদের ঐতিহ্য আগামী প্রজন্মের কাছে কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। বিভিন্ন প্রদেশে বিমাতাসুলভ ভাষায় শিক্ষিত আদিবাসী মানুষ কোনোদিনও তাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় অনুশাসনের সমন্বয়সাধন করতে পারবে না। এজন্য প্রয়োজন বিভিন্ন প্রদেশের আদিবাসী ভাইবোনদের অলচিকি লিপির মাধ্যমে সে সব চর্চা করা।’’ সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই সাঁওতালি ভাষা তথা অলচিকির বিস্তারে সাঁওতাল বুদ্ধিজীবীদের এগিয়ে আসাটা আজ সবচেয়ে জরুরি।
যে-কোনো জাতির মর্যাদা ও ঐক্য রাখার প্রধান সেতুবন্ধন হলো ভাষা। ভাষাচার্য ড. সুকুমার সেন বলেছেন, ‘‘ভাষা নিয়ে জাতি, জাতি নিয়ে দেশ’’। (বঙ্গ ভূমিকা-পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা - ৩) এই অন্তরতম সত্যকেই বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ মনীষী গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। একইভাবে সাঁওতাল জাতিকে ঐ সত্য অবলম্বন করেই ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন সাধু রামচাঁদ মুরমু, পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমু প্রমুখ সাঁওতাল ভাষাবিদ্। ভৌগোলিক কারণে এক সময়কার ছিন্নভিন্ন সাঁওতাল জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য পণ্ডিত মুরমু তাই বলেছিলেন —
‘‘অল মেনাঃ তামা/বড় মেনাঃ তামা
ধরম মেনাঃ তামা/আমহঁ মেনাম।
অলেম আদ্লেরে/রড়েম আদ্লেরে
ধরমেম আদ্লেরে/আম হুঁম আদঃ।’’
বাংলা অর্থ — আছে তোমার বর্ণমালা/আছে তোমার ভাষা,
আছে তোমার ধর্ম, জীবনেরই আশা।
হারিয়ে গেলে ভাষা তোমার/হারিয়ে গেলে বর্ণ,
নিজেই তুমি হারিয়ে যাবে/হারিয়ে গেলে ধর্ম।
(বাংলা কাব্যরূপ — শ্রী সুবোধ হাঁসদা)
আমাদের দেশ ভারতবর্ষে সব মিলিয়ে ধরলে মোট ভাষার সংখ্যা প্রায় ২১৬টি। সারা পৃথিবীকে এক ছাতার তলায় আনতে গিয়ে অতিদ্রুত আঞ্চলিক ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বৈচিত্রময় রূপগুলি ঢুকে যাচ্ছে ময়দানবের গুহায়। প্রাচীন ভারতের খেরওয়াল গোষ্ঠীর মুণ্ডারি, হো, কুরুখ, শবরসহ চোদ্দ-পনেরোটি শাখার অবস্থা বিপাকে, ইতিমধ্যেই নিরুপায়ভাবে আত্মসমর্পণ করেছে এদেশের আর্য বা তার শাখা ভাষা গোষ্ঠীর কাছে। ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম সাঁওতাল জাতি ও সাঁওতালি ভাষা। তাই আদিবাসী, অ-আদিবাসী সবার মিলিত কণ্ঠ হোক—আমরা হারিয়ে যেতে দেবো না এক সুপ্রাচীন ভাষাকে। সরকারি-বেসরকারি সকলের মিলিত উদ্যোগে নিজস্ব প্রাণশক্তির দুর্দমনীয় তেজে ক্রমশ ঐশ্বর্যশালিনী হোক সাঁওতালি ভাষা। ২২শে ডিসেম্বর সাঁওতালি ভাষার স্বীকৃতি দিবসে এটাই হোক আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার।
(লেখক পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী ও লোকশিল্পী সংঘের পুরুলিয়া জেলা সম্পাদক এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাঁওতালি সমাজ ও সংস্কৃতির গবেষক)
তথ্যসূত্র ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার —
১) ড. শান্তি সিংহ, রঘুনাথ মুরমু সাঁওতালি সাহিত্য ও অলচিকি আন্দোলন, পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমু জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন কমিটি, ডিসেম্বর ২০০৪।
২। ড. জলধর কর্মকারের গবেষণাপত্র।
৩। সাঁওতালি ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস—ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে, বাস্কে পাবলিকেশন, কলকাতা-৯, জুন ১৯৯৯।
৪। সুবোধ হাঁসদার প্রবন্ধ — স্মরণিকা, পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমুর জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন ২০০৫।
৫। কান্তি বিশ্বাসের প্রবন্ধ স্মরণিকা, সাঁওতালি ভাষার আন্তর্জাতিক সম্মেলন, ২০০৫, পশ্চিমবঙ্গ সান্তালি অ্যাকাডেমি।
৬। বিশেষ সাক্ষাৎকার-মহাদেব হাঁসদা, সম্পাদক তেতরে ও সাঁওতালি ভাষা শিক্ষক।
৭। বিশেষ সাক্ষাৎকার – নবীন বেসরা, কবি সাহিত্যিক ও সাঁওতালি ভাষা শিক্ষক।
Post Top Ad
Your Ad Spot
Thursday, March 8, 2018
Home
Unlabelled
সাংবিধানিক স্বীকৃতিতেই কি আটকে থাকবে সাঁওতালি ভাষা?
সাংবিধানিক স্বীকৃতিতেই কি আটকে থাকবে সাঁওতালি ভাষা?
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
Post Top Ad
Your Ad Spot
Author Details
Ut wisi enim ad minim veniam, quis nostrud exerci tation ullamcorper suscipit lobortis nisl ut aliquip ex ea commodo consequat. Duis autem vel eum iriure dolor in hendrerit in vulputate velit esse molestie consequat.
No comments:
Post a Comment